ধর্ম

শবে বরাত গুনাহ মাফের এক সুবর্ণ সুযোগ

  প্রতিনিধি ১৯ মার্চ ২০২২ , ৯:৫৮:৪৭ প্রিন্ট সংস্করণ

শবে বরাত গুনাহ মাফের এক সুবর্ণ সুযোগ

মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ * অসীম দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফের জন্য বাতলে দিয়েছেন অসংখ্য পথ ও পন্থা। পাপাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত বান্দাদের পাপ মুক্তির জন্য দান করেছেন সুবর্ন সুযোগ। যারা এ সুযোগ গ্রহন করবে তাদেরকে তিনি ক্ষমা করবেন, করবেন মর্যাদাবান। নেক কাজের সওয়াব বহুগুনে বাড়িয়ে দিবেন। পাপকে পূণ্যে রুপান্তরিত করবেন, কলুষিত অন্তরকে করবেন আলোকিত। এ সুযোগ সমূহের একটি হলো শবে বরাত। এ যেন আল্লাহ তা’য়ালা নৈকট্য লাভের এবং গুনাহ মাফের বিরাট সুবর্ন সুযোগ।
বর্তমানে শবে বরাত সম্পর্কে সমাজে দুই শ্রেনীর মানুষ রয়েছে।
১. যারা এ রাত নিয়ে প্রচন্ড বাড়াবাড়ি করে, অর্থাৎ বিভিন্ন রকম রেওয়াজ ও বিদআতী কর্ম কান্ডের মাধ্যমে এ রাতটিকে উদযাপন করে থাকে। যা সম্পূর্ন না জায়েজ। এ জাতীয় কর্মকান্ড সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম সব সময় ধর্ম প্রাণ মুসলমানদের অবগত করে আসছেন।
২. যারা শবে বরাত নিয়ে প্রবল ছাড়াছাড়ি করে, অর্থাৎ তারা বলে ইসলামে শবে বরাত এর কোন ভিত্তি নেই। শবে বরাতের সকল হাদিসকে যঈফ, জাল আখ্যায়িত করে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে চলছে। উভয় শ্রেনীর বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ির গন্ডি থেকে বের হয়ে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা আমাদের সবারই দায়িত্ব।
বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি নয় চাই মধ্যম পন্থা
শবে বরাত নিয়ে একদল বাড়াবাড়ি করে থাকে। আরেক দল করে ছাড়াছাড়ি। উভয় দলই ভুল পথে রয়েছে। ইসলাম মধ্যম পন্থার দ্বীন। ইসলামে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি নেই। সুতরাং ইসলাম প্রদর্শিত পথেই শবে বরাত পালন করতে হবে। তবেই কেবল আমরা সিরাতে মুস্তাকিম তথা সঠিক এবং মুক্তির পথে থাকতে পারবো। আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন।
শবে বরাতের সংজ্ঞা ও পরিচিতি
আরবী বছরের অষ্টম মাস শাবান। এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ফার্সি ভাষায় শবে ‘বরাত’ বলা হয়। যার অর্থ ‘মুক্তির রজনী’। অনেক মুফাসসিরের মতে কুরআনের ভাষায় এ রাতকে লাইতুল মুবারাকাহ বা বরকত পূর্ণ রজনী, আর হাদিসের ভাষায় লাইতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত্রি বলা হয়।
শবে বরাতের ফযিলত
১. হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন-
আল্লাহ তা’য়ালা শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে সৃষ্টিকুলের দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান. হাদিস নং- ৫৬৬৫)

২. হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেন-
আল্লাহ তা’য়ালা অর্ধ শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে আগমন করেন , অতঃপর কালব গোত্রের বকরীর পশমের সংখ্যার চেয়ে ও বেশি মানুষকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং- ৭৩৯)
৩. হযরত আয়েশা (রা.) বলেন. রাসূল (সাঃ) এক রাতে দীর্ঘ নামাজ পড়লেন। তাতে দীর্ঘ সিজদা করলেন। আমি তাঁর মৃত্যুর আশংকা করলাম। নামাজ শেষে বললেন হে আয়েশা জানো এটা কোন রাত? এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহ তা’য়ালা এ রাতে ক্ষমা প্রার্থীদেরকে ক্ষমা করে দেন। দয়া প্রার্থীদের প্রতি দয়া করেন এবং বিদ্বেষ পোষনকারীদেরকে নিজ অবস্থায় ছেড়ে দেন। (বায়হাকি শুআবুল ঈমনে ৩/৩৮৩)
শবে বরাতে করণীয়
হযরত আলী (রা.) থেকে বর্নিত নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন, অর্ধ শাবানের রাত নামাজে কাটাও এবং দিনে রোজা রাখো। কেন না আল্লাহ তা’য়ালা শবে বরাতে সূর্যাস্তের পরেই প্রথম আকাশে আসেন এবং বলেন, আছো কোন ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছো কোন রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দিবো। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তা’য়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে করে ডাকতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদিস নং- ১৩৮৮)
শবে বরাত উপলক্ষে আমাদের কি কি করনীয় এ সম্পর্কে হাদিসের দ্বারা এবং ফেকার কিতাবে যা বলা হয়েছে তা থেকে জানা যায়- শবে বরাত উপলক্ষে আমাদের সর্বমোট ছয়টি আমল করার রয়েছে। তার মধ্যে উপরোক্ত হাদিসে তিনটি আমলের কথা বলা হয়েছঃ
১. অর্ধ শাবানের রাত নামাজে কাটাও।
২. পরের দিন রোজা রাখা অর্থাৎ ১৫ই শাবান একটা রোযা রাখা নফল। নফলের নিয়তে এই রোজা রাখলে চলবে।
৩. আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফ চাওয়া, রোগ-শোক থেকে মুক্তি চাওয়া। রিযিক চাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় চাওয়া বা দু’আ করা। এ রাতে যার যা চাওয়ার আছে আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এই তিনটি আমলের কথা পূর্বের হাদিসে বলা হয়েছে।
৪. অন্য এক হাদিসে এসেছে-হযরত আয়েশা (রা.) বলেন যে, একদিন রাতে রাসূল (সাঃ) আমার কাছে আসলেন, গায়ের কাপড় খুললেন। তারপর না শুয়ে আবার কাপড় পরিধান করে বের হয়ে গেলেন। আমার আত্ম মর্যাদা বোধে আঘাত লাগলো। আমি ভাবলাম হযরত (সাঃ) হয়তো আমার কোন সতীনের ঘরে গিয়ে থাকবেন। আমি খুঁজতে বের হলাম। দেখি অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়েছেন কিনা। কিন্তু কোন বিবির ঘরে তাকে খুঁজে পেলাম না। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে অর্থাৎ, মদিনার কবরস্থানে গিয়ে আমি তাকে পেলাম। দেখলাম তিনি আসমানের দিকে হাত তুলে মুমিন-মুসলমান, নর-নারী এবং শহিদদের জন্য দু’আ করছেন। তাদের জন্য ইস্তেগফার করছেন। এটা ছিল বরাতের রাতের ঘটনা। (তিরমিযি)
এই হাদিসে শবে বরাতের আরেকটা আমলের কথা পাওয়া গেল যে, আপনজন যারা দুনিয়া থেকে চলে গেছে, শুধু আপনজন নয় সমস্ত মুমিন নর-নারী যারা দুনিয়া থেকে চলে গেছে দ্বীনের রাস্তায় আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের সবার জন্য এ রাতে দুআ করার কথা এই হাদিসে পাওয়া গেল।
৫. পাঁচ নম্বর আমল হলো- যেটা এই হাদিস থেকে জানা গেল- যে রাসূল (সাঃ) জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থানে গিয়েছিলেন জেয়ারতের জন্য। অতএব এই রাতে জেয়ারতের জন্য কবরস্থানে যাওয়া যায়। তবে একটা বিষয় লক্ষনীয়। তা হলো রাসূল (সাঃ) কবর জেয়ারত করতে গিয়েছিলেন একাকী, কাউকে ডেকে দল বল সহকারে, আড়ম্বর করে যাননি। যদি দল বল সহকারে আড়ম্বর করে যাওয়ার বিষয় হতো, তাহলে রাসূল (সাঃ) সকলকে ডেকে নিয়ে সেভাবেই যেতেন। অতএব কেউ চাইলে এ রাতে ঢাক ঢোল না পিটিয়ে , আড়ম্বর না করে কবর জিয়ারত ও করে আসতে পারেন। প্রত্যেকটা আমল সেভাবেই করতে হবে যে ভাবে কুরআন হাদিসে এসেছে। রাসূল (সাঃ) আমাদের মডেল। অন্য কেউ আমাদের মডেল নয়। রাসূল (সাঃ) শরিয়তের প্রবর্তক, তাঁর থেকেই শরিয়তের প্রবর্তন হয়েছে। তিনি যেভাবে যে আমল করেছেন সেভাবে করাটাই হলো সহীহ আমল।
৬. যেহেতু এই রাত ইবাদতের রাত এবং ফযিলতের রাত, তাই যত পবিত্র অবস্থায় ইবাদত করা যাবে ততোই বেশি উত্তম হবে। এজন্য এই রাতে গোসল করাটাকে ফোকাহায়ে কেরাম মোস্তাহাব বলেছেন।
এই ছয়টি আমলের কথা আমরা কুরআন হাদিসের মধ্যে এবং ফেকাহর কিতাবে পাই। এর অতিরিক্ত কোন আমলের কথা কুরআন হাদিসের মধ্যে আসেনি, ফেকাহর কেতাবেও নেই।
শবে বরাতে বর্জনীয় কাজ সমূহ
শবে বরাত বিদআত নয়, তবে আমাদের সমাজে এমন কিছু কাজ পরিলক্ষিত হয় যা সম্পূর্ন বিদআত ও ভিত্তিহীন। তাই প্রত্যেক মুসলমানের এ সকল বিদআত ও কুসংস্কার থেকে সম্পূর্নরুপে বিরত থাকা উচিত।
একঃ শিন্নী, হালুয়া-রুটি বা মিষ্টি বিতরন করা।
দুইঃ মসজিদ, ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালতে আলোকসজ্জা করা।
তিনঃ পটকাবাজী, আতশবাজী করা।
চারঃ কবর বা মাজারে ফুল দেওয়া, আলোকসজ্জা করা।
পাঁচঃ দল বেঁধে কবরস্থানে যাওয়া।
এই সমস্ত কাজ গুলো আমরা নিজেরাতো করবইনা বরং আমাদের ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, আপনজন কাউকে এগুলো করতে দিবো না। আমাদের দ্বারা কোন পাপ কাজের সহযোগিতা যেন না হয়। পাপ কাজের সহযোগিতা করাও পাপ। শক্তি থাকলে পাপ কাজে বাধা না দেওয়াও পাপ।
শবে বরাত একটা বিশেষ মর্যাদার রাত। কাজেই এ রাতে গোনাহ করা হলে সেটা বেশি বড় গোনাহ হয়ে দাঁড়াবে। এই রাতে সব রকম গোনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আমরা ইবাদত করবো এবং আল্লাহর কাছে চাইতে থাকবো। যতো কিছু আমরা আল্লাহর কাছে চাইবো, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চাওয়ার হলো গোনাহ থেকে মুক্তি চাওয়া। গোনাহ থেকে মুক্তি চাওয়াই হলো সবচেয়ে বড় চাওয়া। গোনাহ থেকে মুক্তি পাওয়াই হলো সবচেয়ে বড় পাওয়া।
গোনাহ থেকে মাফ পাওয়ার জন্য খাঁটি তওবা-এস্তেগফার করা জরুরী। খাঁটি তওবা-এস্তেগফারের জন্য চারটি শর্ত জরুরী। যদি এই চারটি শর্ত পূরা হয়, তাহলে খাঁটি তওবা হবে এবং গোনাহ মাফ হবে।
এক নাম্বার শর্তঃ অতীতে যতো গোনাহ হয়ে গেছে, তার জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হওয়া।
দুই নাম্বার শর্তঃ যে গোনাহ থেকে আমি তওবা করবো, ঐ গোনাহ এখনই বন্ধ করে দিতে হবে। গোনাহ করে যাচ্ছি আর মুখে মুখে মাফ চেয়ে যাচ্ছি, তাহলে ঐ গোনাহ মাফ হবে না।
তিন নাম্বার শর্তঃ ঐ গোনাহ সামনে আর কখনও করব না-মনে মনে এরকম প্রতীজ্ঞা নিতে হবে। মনে মনে পাকাপোক্ত নিয়ত করতে হবে যে, ঐ গোনাহ আর কোনদিন করব না।
চার নাম্বার শর্তঃ যে গোনাহ থেকে আমি তওবা করবো, এই গোনাহ যদি কোন বান্দার হক নষ্ট হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে বান্দার হক আদায় করার ব্যবস্থা করতে হবে। তওবার এই চারটি শর্ত পূরণ করার পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দিবেন।

এই রাতে বিশেষভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। গোনাহ থেকে মাফ চাইতে হবে। এটাই তো সবচেয়ে বড় চাওয়া। যে কথা আগেও বলা হয়েছে- মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো গোনাহ থেকে মাফ চাওয়া, সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো গোনাহ থেকে মাফ পাওয়া। আমি অনেক কিছু পেলাম বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত, পদ-মর্যাদা অনেক কিছু পেলাম, কিন্তু কেয়ামতের দিন আমি ক্ষমা পেলাম না, যার ফলে আমাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাহলে তো আমি কিছুই পেলাম না। এজন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহপাক আমাদেরকে সব আমল সহীহ ভাবে করার তাওফীক দান করুন। আমিন।
খতীবঃ মেরাদিয়া কবরস্থান মাদরাসা মসজিদ, খিলগাঁও, ঢাকা, ০১৯১৬৯৮০৩০৮

Powered by