ধর্ম

রমাযান মাসের ফযিলত ও আমাদের করণীয়

  প্রতিনিধি ৩১ মার্চ ২০২২ , ৫:০০:২০ প্রিন্ট সংস্করণ

মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ:

আর মাত্র কয়েকদিন পর শুরু হতে যাচ্ছে রমযান মাস। রমযান মাস বছরের সমস্ত মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মাস, সবচেয়ে বেশি ফযীলতের মাস, সবচেয়ে বেশি ছওয়াব অর্জনের মাস। রমযান মাস হলো মুসলমানদের ছওয়াব অর্জন করার সিজন।

ব্যবসায়ীদের যেমন ব্যবসার সিজন থাকে, যখন তাদের ব্যবসা খুব বেশি হয়, মুনাফা বেশি হয়। তদ্রুপ মু’মিনের জন্য রমযান মাস হল ছওয়াবের সিজন যখন একটা নফল ইবাদতের ছওয়াব একটা ফরযের সমতুল্য হয়ে যায় এবং একটা ফরযের ছওয়াব ৭০ টা ফরযের সমান হয়ে যায়। এমনিতে নফল আর ফরযের মধ্যে কোন তুলনা হয় না। একজন মানুষ যদি এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা করে অর্থাৎ ওয়াক্ত মত না পড়ে, তাহলে সারাজীবন যদি সে নফল নামাজ পড়ে, তবুও ঐ ওয়াক্তিয়া ফরজ নামাযের সমতুল্য হবে না। ফরযের মর্যাদা এতো বেশি তা সত্তে¡ও বলা হচ্ছে রমযান মাসে একটা নফল ইবাদাত করলে একটা ফরযের সমতুল্য হয়ে যাবে। এ হিসেবে চিন্তা করলে বুঝা যায় রমযান মাসে এক একটা আমলের ছওয়াব কতগুনে বর্ধিত হয় তা, হিসাব করা কঠিন তাই রমযান হল ছওয়াব অর্জন করার সময়, রমযান হলো ছওয়াব অর্জন করার সিজন।

ব্যবসায়ী তার সিজন আসার আগে মনে মনে সম্পূর্ন প্রস্তুতি নিয়ে নেয় যে, সামনে সিজন আসছে সিজনকে আমার কাজে লাগাতে হবে। অন্য কোন কাজ আমি বুঝিনা। অন্য কোথাও বেড়ানো, অন্য কোথাও ঘোড়াঘুড়ি আমি বুঝিনা। সিজনকে আমার কাজে লাগাতে হবে। সিজনের সময় আমি ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বুঝিনা। রমযানের জন্য এরকম মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। দুনিয়ার যত ঝামেলা আছে রমযান আসার পূর্বেই সেসব ঝামেলা থেকে আমি মুক্ত হয়ে যাবো। অন্তত এতটুকু মুক্ত হয়ে যাবো যে, রমযানে রোযা রাখতে রমযানের অন্যান্য ইবাদত যেমনঃ তারাবীহ পড়া, বিশেষ তেলাওয়াত করা ইত্যাদির জন্য যেন কোন বাঁধা না থাকে। ঝামেলাগুলি আগেই আমি চুকে নিব, সব বাঁধা-বিপত্তি আগেই আমি দূর করে নিব। রমযানের জন্য আগে থেকেই এ রকম প্রস্তুতি নেয়ার দিকে ইঙ্গিত করে রাসূল বলেছেন- “তোমরা শাবান মাসের চাঁদ ঠিক মতো গণনা করে রাখ। শা’বানের কয়দিন যাচ্ছে আর কয়দিন রমযান আসতে বাকি আছে ঠিক মতো খেয়াল রাখ। রমযানের প্রতি গুরুত্বের খাতিরে তোমরা এটা করো।”

এখানে বোঝানো হচ্ছে যে, সামনে রমযান আসছে রমযান আসার আগেই যেন রমযানের জন্য তোমার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যায়। কেউ যদি আগে থেকে মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তাহলে রোযার সময় আর কোন সমস্যা তার থাকবে না।

মাহে রমযানের ফযিলত:

রমযান মাসের ফযিলত ও বরকত অনেক। কারন এ মাসে আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এবং হাদিছে এ মাসকে বরকতময় মাস বলা হয়েছে। এ মাসের ফযিলত সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করছি-
রাসূল (সা.) বলেন, যখন রমযান মাস আসে তখন তার (সম্মানে) রহমতের (বেহেশতের) দরজা খুলে দেয়া হয় এবং দোযখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানকে বন্দী করা হয়। (মুসলিম)
রাসূল (সা.) এক আনসারী মহিলাকে বলেন, রমযান এলে তুমি উমরা করবে। কারন রমজানের উমরাতে হজে¦র সমান সওয়াব । (নাসায়ী)

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তোমাদের উপর রমযানের রোজা ফরজ করেছেন আর আমি তারাবীহ সুন্নত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রোযা রাখবে এবং তারাবীহ পড়বে সে ব্যক্তি গোনাহ থেকে এমনভাবে মুক্ত হবে যেন তাকে তার মা আদ্য ভূমিষ্ঠ করেছে। (নাসায়ী)

রাসূলে কারীম (সা.) বলেন, রমযান মাস উপলক্ষ্যে আমার উম্মতকে এমন পাঁচটি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যা অন্য কোন নবীকেও দেয়া হয়নি। যথা-
ক. রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকটে মেশকের চেয়ে বেশি ঘ্রানযুক্ত।
খ. ইফতার না করা পর্যন্ত তাদের জন্য ফেরেশতারা ইসতেগফার করে।
গ. তাদের জন্য প্রতিদিন জান্নাতকে সজ্জিত করা হয়।
ঘ. দুষ্টু শয়তানকে বন্দী করা হয়।

ঙ. এবং রমজানের শেষ রাতে আমার সকল উম্মতকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। (তারগীব)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সা. বলেন তোমাদের নিকট রমজান আসছে তা বরকতময় মাস। এ মাসে রোযা রাখা আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের উপর ফরজ করে দিয়েছেন। এ মাসে আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুষ্টু শয়তানকে বন্দী করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যার মর্যাদা হাজার মাস অপেক্ষা বেশি। যাকে সে রাতের কল্যান হতে বঞ্চিত রাখা হয় সেই প্রকৃত মাহরুম। (নাসায়ী)

হযরত সালমান ফারেসী (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এ মাসে ১টি নফল কাজ করবে সে যেন অন্য মাসে ১টি ফরজ করল। আর যে এ মাসে ১টি ফরজ কাজ করবে সে যেন অন্য মাসে ৭০ টি ফরয কাজ করল। (বায়হাকী)

রমযান মাসে নবীজী (সা.) এর আমল:

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আযমায়িনগন বলেন, রমযান মাস শুরু হলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের মধ্যে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেত।

ইবাদতের মাত্রা বৃদ্ধি পেত। নবীজী সা. সাধারন সময়েই এ পরিমান ইবাদত করতেন যে, তাঁর পাঁ ফুলে যেত। রমযান মাসে তাঁর ইবাদতের মাত্রা আরো বেড়ে যেত।
নবীজী (সা.) আল্লাহর রাস্তায় খুব বেশি বেশি ব্যয় করতেন। দু’হাত খুলে খরচ করতেন। মন ভরে দান করতেন।
নবীজী (সা.) দুয়া ও মোনাযাতে খুব বেশি রোনাযারী করতেন। খুব বেশি বেশি কান্নাকাটি করতেন।
রমযান মাসে নবীজী (সা.) এর মধ্যে এই তিনটা বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যেত।
খুব বেশি ইবাদত করতেন।
খুব বেশি কান্নাকাটি করতেন।
এবং অধিক পরিমানে দান-খয়রাত করতেন।

রাসূল (সা.) রমযান মাসে আরো চারটি আমল বেশি বেশি করে করতেন।
১/ বেশি বেশি কালেমা পাঠ করতেন।
২/ বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন।
৩/ জান্নাত চাইতেন।
৪/ জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইতেন
এবং এই উম্মতকেও এই কাজগুলো করার জন্য আদেশ করেছেন।

এই আমল গুলোকে মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম পড়ার সুবিধার জন্য একসাথে লিপিবদ্ধ করেছেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু নাস্তাগফিরুকা ও নাসআলুকাল জান্নাতা ওনাউযুবিকা মিনান্নার।
এ বিষয়গুলোর প্রতি আমরাও যত্নবান হই। বেশি বেশি ইবাদত করি। ইবাদত করতে করতে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলি। ঘুম আসলে নিজেকে সম্বোধন করে বলুন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জাগো, কাল কেয়ামতের দিন আল্লাহর দিদার লাভ করবে। চোখকে বলুন আজ একটু কষ্ট করো আজ একটু কম ঘুমাও। কবরে অনেক মিষ্টি মধুর ঘুম দিতে পারবে।
এই রমযান মাস রাত জাগার মাস, কম ঘুমানোর মাস এ মাসে আরাম-বিশ্রাম কমিয়ে দিন। নিজেকে পূর্ব থেকে প্রস্তুত করুন। বেশি বেশি ইবাদত করার জন্য নিজেকে তৈরি করুন। আল্লাহ আমাদেরকে পুরা রমযান মাস ইবাদত বন্দেগীতে কাটানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।

খতিবঃ মেরাদিয়া কবরস্থান মাদরাসা মসজিদ

Powered by