ধর্ম

মহাপূণ্যময় রজনী শবে বরাত

  প্রতিনিধি ১৭ মার্চ ২০২২ , ৬:৩৭:১৮ প্রিন্ট সংস্করণ

মুফতী আবুল কালাম আজাদ:

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদাত করার জন্য আমরা যদি সঠিক ভাবে ইবাদাত করতে পারি তাহলে আমাদের জন্য রয়েছে অনন্তময় শান্তির স্থান জান্নাত। আর যদি সঠিক ভাবে ইবাদত করতে না পারি তাহলে রয়েছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। আমরা মানুষ এমন যে নিরপরাধি কেউ নাই। কোন না কোন ভাবে আমরা অপরাধি হয়েই আছি।

আর এই সমস্ত অপরাধ থেকে যেন আমরা মুক্তি পাই এবং অল্প সময়ে বেশি সোয়াব অর্জন করতে পারি সেই জন্য আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কিছু দিন, সময় দান করেছেন যে সময়ে অল্প ইবাদাতে বেশি নেকি যেমন রমজান মাসে একটি আমল অন্নন্য মাসে সত্তর গুন আমল করার সমান, অনুরুপভাবে আল্লাহ পাক এমন একটি রাত দান করেছেন যে রাতে রব্বে কারিম নিজেই শেষ আসমানে এসে বান্ধাদেরকে ডাকতে থাকেন যে কার কি সমস্যা আছে, কার কী প্রয়োজন আছে চাও আমি আল্লাহ দিয়ে দিব। সেই রাতকেই বলা শবে বরাত যেটাকে হাদীসের ভাষায়, “লাইলাতুল নিসফি মিন শাবান” অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যে রজনী এবং এই রাতের ব্যপারে হাদীসে অনেক বর্ণনা রয়েছে।

যেমন ১। হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবি করিম (সঃ) ইরশাদ করেন যখন লাইতুন নিসফি মিন শা’বান, শাবান মাসের মধ্য রজনী (১৫ইশা’বান) আসে সে রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের উপর রহমতের দৃষ্টি দেন। এবং দুই শ্রেণির ব্যাক্তি ছাড়া সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। সেই দুই শ্রেণি হলো, (ক) মুশরিক/কাফের (খ) হিংসা বিদ্বেশ পোষণকারী। সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৫৬৬৫,

(২) হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (রা) হতে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (স:) ইরশাদ করেন যখন তোমাদের মাঝে লাইলাতুল নির্সফি মিন শা’বান, শাবান মাসের মধ্যে রজনী আসে সে রাত্রে তোমারা ইবাদাত কর এবং পরের দিন একটি রোযা, রাখো কারণ এই রাতে আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন সন্ধ্যা থেকে ফজর পর্যন্ত দুুনিয়ার আসমানে এসে বান্দাদেরকে ডাকতে থাকেন, আছো কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনা কারী ? আমার নিকট ক্ষমা চাও আমি ক্ষমা করে দিব। আছো কি কেউ অভাবগ্রস্থ আমার কাছে চাও আমি অভাব দূর করে দিব। আছো কি কেউ রোগ আক্রান্ত আমার কাছে চাও আমি রোগ মুক্ত করে দিব ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে বিভিন্ন জিনিসের নাম ধরে ধরে ডাকতে থাকেন সাহীহ সুনানে ইবনে মাজা(হাদীস নং১৩৮৮) সম্মানিত পাঠক বৃন্দ আমরা জানতে পারলাম শবে বরাত সাহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত। এখন জানার বিষয় হলো এ রাতে আমাদের করনীয় কী? যেহেতু এ রাতকে মুক্তির রজনী বলা হয়েছে এবং হাদীস শরিফে মুক্তির কথাটায় স্পষ্ট ভাবে জানা যায়।

 

তাই আমরা মুক্তি পাওয়ার জন্য চেষ্ঠা করবো। এখন কথা হলো কিসের মুক্তি। ও ভাই এই মুক্তির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের মুক্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইতে হবে, গুনার এ জিবন থেকে মুক্তি চাইতে হবে, দুনিয়ার বিপদ আপদ থেকে মুক্তি চাইতে হবে। আমরা তো এমন হয়ে গিয়েছি যেন আমাদেরকে মৃত্যু বরণ করতেই হবে না। আমরা তো মরনের কথা ভুলে গিয়েছি, কবর হাশরের কথা আল্লাহর আদালতের কথা ভুলেই গিয়েছি যদি তাই না হবে তাহলে কেন আমরা আল্লাহর গোলামী করতে পারি না, মসজিদে আযান হয় আমরা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে থাকি কেমন যেন মনেই হয় না যে আমাকে আল্লাহর নিকট জবাব দিতে হবে, নতবা জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। অথচ জান্নাতে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত দশ জনের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যাক্তি যিনি হযরত ওমর (রা:) তার জীবনি পড়লে দেখবেন কবরের ভয়ে কাদতে কাদতে তার দুই চোখ ঘা করে ছেলেছে, যদি বলা হতো হে আমীরুল মুমিনীন আপনি জান্নাতের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত ব্যক্তি আপনি এতো কান্না করছেন কেন ? নবীজি (স:) বলেছেন আবু বকর ছিল জান্নাহ ওমর ছিল জান্নাহ অর্থ আবু বকর (রা:) জান্নাতী, ওমর (রা:) জান্নাতী, তখন হযরত ওমর (রা:) বলতেন আমার মন বলে আল্লাহ যদি জাহান্নামে যাওয়ার জন্য কোন এক জন ব্যক্তিকে নির্ধারন করেন আমার ভয় সেই এক জন যদি আমি ওমর হই। আহ কি চিন্তা করতেন তারা পরকালকে নিয়ে। আর আমরা এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়া নিয়ে কত রঙ্গিন স্বপ্ন দেখতেছি কিন্তু কেউ কি জানি আমার এ স্বপ্ন আখেরাতে কতটুকু কাজে আসবে, কোনই কাজে আসবে না। সম্মানিত পাঠক বৃন্দ তাহলে

আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইতে হবে। আর এ রাতে আমরা বিশেষ চারটি কাজ করবো। (১) এ রাতে নফল ইবাদত ও নেক আমল বেশি বেশি করবো। কারন আল্লাহ তা’আলা কুরআনুল করিমে এরশাদ করেন “ইন্নাল হাসানাত ইউয হিবনাস সায়্যিয়াত” অর্থাৎ নিশ্চয় নেক আমল গুনা সমূহকে মিটিয়ে দেয়। সূরা হুদ আয়াত-১১৪। তাই আমরা নেক আমল যত বেশি করবো আমার জীবনের ততো গুনাহ আল্লাহ পাক মিটিয়ে দিবেন। (২) পরের দিন একটি রোজা রাখবো।

 

কারণ রোজাদারদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন রোজাদারের মুখের দূূর্গন্ধ মিশক আম্বরের চেয়েও বেশি প্রিয়, এবং হাশরের ময়দানে প্রচন্ড গরম এবং ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আল্লাহ আরশের ছায়ার নিচে খাবারের ব্যবস্থা করবেন, সুবহানাল্লাহ। (৩) এ রাতে বেশি বেশি দোয়া করবো। সমস্ত বিপদ আপদ, শোক রোগ, অভাব অনটন থেকে মুক্তি চাইবো। (৪) যারা দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেন তাদের জন্যও মাগফেরাতের দোয়া করবো। কারন হাদিসে এসেছে আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাতে নবিজী (স:) হঠাৎ ঘরে নেই আমি নবিজীকে তালাশ করতে বের হলাম, দেখলাম রাসুলুল্লাহ (স:) জান্নাতুল বাকি কবরস্থানের পাশে আসমানের দিকে মাথা উচু করে আছেন নবিজী ফিরে এসে বললেন।

 

হে আয়েশা তুমি কি মনে করে আল্লাহ এবং তার রসূল তোমার হক নষ্ট করবেন অতপর নবিজী (স:) বলেন যখন লাইলাতুল নিফসি মিন শাবান অর্থাৎ শবে বরাতের রাত আসে আল্লাহ পাক দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং ব্যপকভাবে বান্ধাদেরকে ক্ষমা করে দেন। এত সংখ্যক লোককে ক্ষমা করেন যে বনু কালব গোত্রের যত বকরি আছে ওদের যত পশম আছে তার চেয়েও বেশি সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।

 

সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ১৩৮৯ অর্থাৎ সে যুগের বনু কালব গোত্রের লোকেরা সব চেয়ে বেশি ছাগল পালতেন তাই তাদের নাম ধরে উদাহর দিয়েছেন। যে এত পরিমান মানুষকে আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দেন। এ হাদীস দ্বারা বিষয়টি প্রমান হয় যে যারা দুনিয়া থেকে পরোলোক গমন করেছেন তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করা, কবর যিয়ারত করা। এবং বিশেষ করে নিজের জীবনের গুনাহর উপরে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করা। কেননা তওবা এমন একটি মাধ্যম যার দ্বারা মানুষ নিষ্পাপ হয়ে যায়। যেমন হাদীস শরিফে এসেছে নবীজি (স) বলেন বান্দা যখন তওবা করে আল্লাহ পাক তাকে এমন করে দেন। যেন সে সবে মাত্র ভুমিষ্ট শিশুর মতো বেগুনাহ, মাসুম বানিয়ে দেন, সুবাহানাল্লাহ। এ জন্য আমরা সমস্ত গুনাহর উপরে তওবা করবো, তবে শুধু তওবা করলেই হবে না বরং তাওবা কবুল হওয়ার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে। (এক) সে শুনাহ সাথে সাথেই ছেড়ে দিতে হবে, নতবা কবুল হবে না। যেমন এক ব্যক্তির কুয়াতে ইদুর পড়ে মারা গিয়েছে এখন সে এক মুফতি সাহেবের নিকট মাসয়ালা জানতে চাইল। কুয়াটি কি ভাবে পবিত্র করা যায় ? মুফতি সাহেব বললেন, ৪০৬০ বালতি পানি উঠালেই পবিত্র হয়ে যাবে।

 

লোকটি ৪০৬০ বালতি পানি এমন কি শতাধিক বালতি পানি উঠিয়েছেন তবুও পানির দূর্গন্ধ দূর হচ্ছে না। সে আবার মুফতি সাহেবকে বললো কি ফতুয়া দিলেন শতাধিক পানি উঠালাম তবুও তো দূর্গন্ধ দূর হচ্ছে না। মুফতি সাহেব বললেন ইদুর কোথায়? সে বললো ইদুর কুয়াতেই আছে মুফতি সাহেব বললেন মরা ইদুর কুয়াতে রেখে সারা জীবন পানি সেচে করলেও কুয়ার পানি পবিত্র হবে না। সম্মানিত পাঠক বৃন্দ অনুরূপ ভাবে গুনাহ বন্ধ না করে যতই তওবা করি সফলতা আসবে না। (দুই) সে গুনাহর উপর অনুতপ্ত, অনুসূচনা নিয়ে আসতে হবে। (তিন) ঐ গুনাহ ভবিষ্যতে করবো না বলে প্রতিজ্ঞা করতে হবে। (চার) সেগুনাহ যদি কোন ব্যক্তির হক সম্পর্কিত হয় তাহলে তা আদায় করতে হবে। আর যদি আদায় করার সুযোগ না থাকে, যেমন সামর্থ নেই অথবা সে লোকটাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা তাহলে তার ওয়ারিশদের নিকট আদায় করতে হবে, অথবা ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে, অন্যথায় ক্ষমা পাওয়ার কোন সুযোগ নাই।

কারন বান্দার হক এতোটা গুরুত্বপূর্ণ যে আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন কুরআনে ইরশাদ করেন “নিশ্চয় আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে আমানত সমূহ তার হকদারের নিকট পৌঁছে দিতে” সূরা নিসা আয়াত৫৮। মোট কথা যার হক তার নিকট পৌছে দিতে হবে অন্যথায় কারো হক নষ্ট করে যতোই সে ব্যপারে তওবা করুক না কেন সফলতা আসবে না। আর আমরাতো বান্দার হক কী? এটাকে কোন কিছু মনে করি না একটি খারাপ জিনিস ভালোবলে বিক্রী করতেছি, মিথ্যা বলতেছি, বান্দার হক নষ্ট করতেছি অথচ নবী (স:) বলেন যে আমাদেরকে (মানুষ কে) ধোকা দেয় সে আমার উম্মতের অন্তভূক্ত নয়।

 

ইমামে আজম অবু হানিফা (রহ:) এর একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। তিনি একজন বড় মাপের কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন একটি কাপড় ত্রুটিযুক্ত থাকার কারনে কর্মচারী কে বললেন ক্রেতাকে ক্রটির কথা বলে কিছু কম দামে বিক্রী করবে। কিন্তু কর্মচারী ভুলে আসল দামে বিক্রী করে, পরে আবু হানিফা (রহ.) ঐ কাপড়ের সব টাকা সদকা করে দেন। এটা ছিল বান্দার হকের প্রতি তাদের গুরুত্ব, অন্যের হক আমি খাবো কেন। সম্মানিত পাঠক বৃন্দ শবে বরাত উপলক্ষ করে এ রাতে কোন প্রকার আতশ বাজিপটকা ফুটানো এবং হালুয়া রুটি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।

অতএব আমরা সবাই আল্লাহর সে বিধান গুলো মেনে চলবো। এবং শবে বরাতে বেশি বেশি নফল ইবাদত ও দোয়া করবো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে শবে বরাতের ফজিলত হাসিল করার তাওফিক দান করুন।
আমিন।

লেখক: ইসলামী লেখক ও গবেষক

আরও খবর

Sponsered content

Powered by