সম্পাদকীয়

দরবারে সালতানাত উসমান গাজী থেকে অটোম্যান সাম্রাজ্য

  প্রতিনিধি ৭ এপ্রিল ২০২২ , ৬:১৫:৪২ প্রিন্ট সংস্করণ

মো. খবির উদ্দিন:

যখন মঙ্গোলীয় পৈশাচিকতায় সাম্রাজ্যের পর সামাজ্য ভূলুন্ঠিত, যখন বাগদাদের নিরীহ মানুষের চিৎকারে গোটা মধ্য প্রাচ্যের আকাশ বাতাস থমকে গিয়েছিল, যখন সভ্যতার পর সভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই জন্ম হয় আরতুগ্রুল গাজীর ছেলে উসমান গাজীর। তিনিই ছিলেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রথম সুলতান। উসমান ১৩ ফেব্রæয়ারি ১২৫৮ (মতান্তরে) তৎকালীন আনাতোলিয়া (বর্তমান তুরস্কে) জন্মগ্রহণ করেন। সাম্রাজ্যের প্রথম গোড়াপত্তনকারী সম্রাট ছিলেন আরতুগ্রুল গাজী। আর শেষ খলিফা ছিলেন দ্বিতীয় আবদুল মজিদ (১৯২২-১৯২৪)। মধ্যযুগের ১২৯৯ থেকে ১৯২৪ সুদীর্ঘ ৬২৫ বছরের ইতিহাস। অটোম্যান শাসনের গৌরবময় ইতিহাস। যে খিলাফতটি ছিল মুসলিম জাহানের সর্ববৃহৎ খিলাফত। যে সাম্রাজ্যের বিস্তৃত রূপ ছিল এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার ১০০ টিরও অধিক দেশ। সীমানা উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপের হাঙ্গেরি, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস ও রাশিয়ার ক্রিমিয়া থেকে পূর্বে জর্জিয়া।

 

আর আরবের ইয়েমেনসহ মুসলমানদের গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ। এক কাল্পনিক বিজয়ের ইতিহাস। অটোম্যানদের উত্তরসূরি বর্তমান মুসলিম শাসকদের সামগ্রিক চরিত্রের সঙ্গে এ বিজয় বেমানান। বর্তমান মুসলিমদের মেধা, রুচি ও শিক্ষার ভগ্নদশা। তাদের শিল্পকর্ম, শিক্ষা আর গবেষণার দৈন্যদশা। গোটা মুসলিম বিশ্বে ধর্ম ও বিজ্ঞান চর্চার পশ্চাৎপদতা। অনৈক্য, অস্থিরতা আর আন্তঃকলহের নেতিবাচকতা। মধ্যপ্রাচ্যের অনৈতিক ভোগ-বিলাসিতা আর বিজ্ঞানবিমুখতা। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে অটোম্যানদের ইতিহাস এক কল্পকাহিনী বলেই মনে হতে পারে। হতে পারে কল্পনাবিলাসী কোনো এক বিজয় কাহিনী। কিন্তু না, পৃথিবীর সকল বিজয়ের বড় বিজয় হলো অটোম্যানদের বিজয়। বিশ্বের সেরা সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্য হলো অটোম্যান সাম্রাজ্য। সেরা বিস্ময়ের বিস্ময় হলো অটোম্যান বিস্ময়। বিশ্ব ইতিহাসের স্বর্ণালী পাতায় জ্বলজ্বল করা একটা নাম হলো অটোম্যান সাম্রাজ্য।

Ottoman  নাম এসেছে Osman থেকে। ‘অটোম্যান’ শব্দটি উসমান শব্দের বিকৃত রূপ, মূলত উসমান ছিলেন এক তুর্কি বীরযোদ্ধা। তাঁর পিতা ছিলেন আরতুগ্রুল গাজী ওরফে আরতুগ্রুল বেগ সালজুকী এবং মাতা হালিমা খাতুন। আরতুগ্রুল এর পূর্ব পুরুষ ছিলেন ‘সালজুক’। ‘সালজুক’ জন্মগতভাবে ছিলেন অমুসলিম। জাতিতে তিনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী তথা নাস্তিক। প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন। ‘সালজুক’ কর্তৃক ইসলামী জগতকে ধ্বংস করে দিতে আদিষ্ট হয়েছিলেন আরতুগ্রুল গাজী। নির্দেশ মানতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞও ছিলেন আরতুগ্রুল গাজী, কিন্তু ঘটনাক্রমে তার হাতেই প্রতিষ্ঠা হয় উসমানীয় খিলাফত বা অটোম্যান সাম্রাজ্য।

 

প্রথম উসমানের মৃত্যুর পর উসমানীয় শাসন ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্ত এবং বলকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। উসমানের ছেলে প্রথম ওরহান ১৩২৪ সালে বুরসা জয় করেন এবং একে উসমানীয়দের রাজধানী করা হয়। বুরসার পতনের ফলে বাইজেন্টাইনরা উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারায়। ১৩৮৭ সালে ভেনিসিয়ানদের কাছ থেকে সেলোনিকা জয় করে নেয়া হয়। ১৩৮৯ সালে কসোভো জয় করার পর অত্র অঞ্চলে সার্বিয়ান শক্তির সমাপ্তি ঘটে। ফলে ইউরোপীয়দের দিকে উসমানীয়দের অগ্রযাত্রা সহজ হয়। ১৩৯৬ সালে নিকোপোলিসের যুদ্ধকে মধ্যযুগের শেষ ব্যাপকভিত্তিক ক্রুসেড হিসেবে দেখা হয়। এই যুদ্ধে উসমানীয়রা জয়ী হয়েছিল। বলকানে তুর্কিদের অগ্রযাত্রার সাথে কনস্টান্টিনোপল জয় করা কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কনস্টান্টিনোপলের চারদিকে সকল এলাকা এসময় উসমানীয়রা নিয়ন্ত্রণ করত। তুর্কি মঙ্গোলিয়ান সুলতান তৈমুর আনাতোলিয়া আক্রমণ করলে বাইজেন্টাইনরা সাময়িকভাবে উসমানীয়দের হাত থেকে রেহাই পায়। ১৪০২ সালে আঙ্কারার যুদ্ধে পৃথিবীর শাসক তৈমুর লং উসমানীয়দের পরাজিত করেন এবং সুলতান প্রথম বায়েজিদকে বন্দী করা হয়। ফলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

 

বায়েজিদের সন্তানরা উত্তরাধিকার দাবি করলে ফলশ্রæতিতে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধ ১৪০২ থেকে ১৪১৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শেষ পর্যন্ত প্রথম মুহাম্মদ সুলতান হয়ে গৃহযুদ্ধ দমন করে উসমানীয়দের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। ১৪২১ সালে প্রথম মুহাম্মদের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মুরাদ মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন (১৪২১-১৪৪৪ এবং ১৪৪৬-১৪৪৮)। প্রথম মোহাম্মদ গৃহযুদ্ধ মুক্ত করলেও ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। দ্বিতীয় মুরাদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় অনাস্থা এবং বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় মুরাদ দীর্ঘ আট বছর যাবত সেগুলোকে কঠোর হস্তে দমন করেন। বিদ্রোহ দানকারী আইদিনি, জেরমিয়ানি, মেনতেশে ও তেকে রাজ্যকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। ১৪২৮ সালে কারামানি যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হন। ১৪৩০ সালে তিনি বলকানে উদ্ভুত ষড়যন্ত্র রুখে দেন। ১৪৩৯ সালে তিনি সম্পূর্ণ সার্বিয়াকে দখল করেন। ১৪৪৪ সালে তিনি অবসর নেন এবং তার পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদকে সিংহাসন প্রদান করেন। ১৪৪৬ সালে তিনি পুনরায় সিংহাসনে আসীন হন। ১৪৪৮ সালে তিনি কসোভার দ্বিতীয় যুদ্ধে খ্রিস্টান যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৪৫০ সালে তিনি আলবেনিয়া বিজয় করেন। ১৪৫১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় মুরাদের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদ (১৪৫১-১৪৮১) মাত্র ১২ বছর বয়সে সুলতান পদে সমাসীন হন। ১৪৪৪ সালের আগস্ট থেকে ১৪৪৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি সুলতান ছিলেন। এরপর ১৪৫১ সাল থেকে ১৪৮১ পর্যন্ত টানা ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন।

দ্বিতীয় মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে মনোযোগ দেন। ১৪৫৩ সালে তিনি এটি দখল করে নেন। সম্রাট দ্বিতীয় মুহাম্মদ এ নগরীর নতুন নাম দেন ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুল অর্থ ইসলামের শহর। এটি বর্তমানে বসফরাস প্রণালির তীরে অবস্থিত। এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত একটি ঐতিহ্যে ভরপুর প্রসিদ্ধ নগরী। শহরটি তুরস্কের অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ্য, পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত রূম শব্দটি দ্বারা এ শহরকেই বুঝানো হয়েছে। অতঃপর বিজয়ের পর সেখানে একটি আইয়ুব সুলতান মসজিদ নির্মাণ করেন। এ জয়ের পর তিনি হাগিয়া সোফিয়াকে মুক্ত ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় মুহাম্মদ এটাকে মসজিদে রূপান্তর করেন। ফলে এখানে ইসলামী শাসনের ভিত্তি মজবুত হয়। দ্বিতীয় মুহাম্মদ ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী শিল্প নির্মাতা। তিনি একাধারে তুর্কি, আরবি, ফারসি, গ্রিক ও ইতালি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তার রাজ্যে তিনি অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার শাসনামলেই প্রণীত হয় প্রথম ফৌজদারি ও শাসনতান্ত্রিক আইন। তার অবদানের কারণে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তুর্কি ১০০ লিরা নোটে তার ছবি এবং নাম ছাপানো ছিল। ১৪৮১ সালে সাহসী এ বীর ইস্তাম্বুলে মৃত্যুবরণ করেন।

অটোম্যান সাম্রাজ্য তার ক্ষমতার সোনালী সময়টি পার করেছে অবশ্য ষোড়শ-সপ্তাদশ শতকের সময়কালটিতে। তখন তাদের নেতা হিসেবে সিংহাসনে আসীন ছিলেন সুলতান প্রথম সুলাইমান। তখন এটি একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ মধ্য ইউরোপের কিছু অঞ্চল, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা এবং হরন অব আফ্রিকা বলে পরিচিত উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার উপদ্বীপের উপর ছিল তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ১৭শ শতাব্দীর শুরুতে সাম্রাজ্যে ৩৬টি প্রদেশ ও বেশ কয়েকটি অনুগত রাজ্য ছিল। আঠারো শতকের মাঝামাঝি দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। ইউরোপীয় প্রতিপক্ষ রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও হ্যাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের তুলনায় তাদের সামরিক শক্তি ততদিনে হ্রাস পাওয়া শুরু করেছিল।

 

লেখক

লেখক

 

তবে সুলতানদের অযোগ্য উজিরে আজম, দুর্বল ও অপ্রতুল অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনী, দুর্নীতিপরায়ণ অফিসার, লোভী শত্রু, কুসংস্কার, পথভ্রষ্ট সুফিবাদ, বিপদগামী দলসমূহের অপতৎপরতা, সাম্রজ্যজুড়ে অন্যায় অবিচার বেড়ে যাওয়া, স্বেচ্ছাচারিতায় নিমগ্নতা ও বিশ্বাসঘাতক মিত্রদের কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রের দুর্বলতা ক্ষতির কারণ ছিল। এর ফলে প্রাদেশিক অভিজাত ব্যক্তিবর্গ ধীরে ধীরে কনস্টান্টিনোপলের শাসন উপেক্ষা করতে থাকে। দ্বিতীয়ত ইউরোপীয় শত্রুদের সামরিক সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল কিন্তু সে তুলনায় উসমানীয়দের সেনাবাহিনীতে অগ্রগতি হয়নি। শেষ পর্যায়ে যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি বিশ্ববাণিজ্য অন্যদিকে মোড় নেয়া ইত্যাদি কারণে উসমানীয় অর্থনীতি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। আঠার শতকের শেষের দিকে এগে আস্তে আস্তে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে সালতানাতদের স্পিড। পতন ত¦রান্বিত হয়ে যায় অটোম্যান সাম্রাজ্যের।

পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পাবার আশায় জার্মানির সাথে বন্ধুত্বের হাত মেলায় তারা। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় অটোম্যান সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হবার পথে চূড়ান্ত ভূমিকাটি পালন করলো। এরপর তাদের অধীনে থাকা বিভিন্ন অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে। প্রায় ছয়শ বিশ বছরের বৃদ্ধ অটোম্যান সাম্রাজ্যের জন্য শেষ পর্যন্ত কবর খুঁড়েছিল তুির্কদের স্বধীনতা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তুর্কিদের বিজয়ই বিশ্বে অটোম্যান সুলতানী শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে দেয়। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর সালতানাত বিলুপ্ত হয় এবং শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর দেশ ছেড়ে চলে যান। ফেলাফত বিলুপ্ত হয় ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ। তাই এখন পর্যন্ত অটোম্যান রাজবংশের দ্বিতীয় আবদ আল-মাজিদকেই বলা যায় মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ খলিফা। বিস্তৃত এ শাসনামলে মোট ছত্রিশজন সুলতান বসেছিলেন অটোম্যানদের নেতার আসনে। অভ্যুদয়, অরাজকতা, বিস্তৃতি, রূপান্তর, নিশ্চলাবস্থা ও পুনর্গঠন, আধুনিকীকরণ ও অবসান এ সাত ভাগে ভাগ করা যায় ছত্রিশ সুলতানের শাসনামলকে।

অটোম্যান সাম্রাজ্য একসময়ে আয়তনের দিক থেকে ২০ লাখ বর্গমাইল পর্যন্ত পৌঁছে। অধিকাংশ সময় রাজতন্ত্র মজলিসে শূরা ও খিলাফত দ্বারা সরকার পরিচালিত হয়ে থাকত। উসমানীয় সুলতান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় অভিভাবক ছিলেন। সুলতান সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও তার রাজনৈতিক ও নির্বাহী ক্ষমতা প্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত থাকত। দেওয়ান বা পরামর্শ কাউন্সিলে পদে উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা উপস্থিত থাকতেন। সুলতানের কিছু দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য উজিরে আজম নিয়োগ করা হয়। নিয়োগ, পদচ্যুতি ও তদারকির ক্ষেত্রে উজিরে আজম অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতেন। পূর্ববর্তী সুলতানের সন্তানদের থেকে নতুন সুলতান নির্বাচন করা হতো। প্রাসাদের স্কুলের কঠোর শিক্ষাক্রম মেধাবী উত্তরাধিকারীদের শিক্ষাদান করার জন্য তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও এখানে ভবিষ্যতে প্রশাসকদের শিক্ষাদান করার জন্য প্রাসাদের স্কুল ব্যবহৃত হতো। মুসলিমদের জন্য মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। এছাড়া খ্রিস্টানদের জন্য ছিল এন্ডেরুন নামক আবাসিক স্কুল। এতে আট থেকে বিশ বছরের মধ্যবর্তী বার্ষিক ৩ হাজার খ্রিস্টান বালককে শিক্ষাদান করা হতো। অটোম্যান সাম্রাজ্যে তিন ধরনের আদালত চালু ছিল। প্রথমত: মুসলিমদের জন্য আদালত, দ্বিতীয়ত: ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য গঠিত আদালত যাতে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা নিযুক্ত হত, তৃতীয়ত: বাণিজ্য আদালত। আদালতের ধরনের পার্থক্য থাকলেও এক আদালতের মামলা অন্য আদালতে নেয়ার প্রচলন ছিল। বাণিজ্য সংক্রান্ত মামলা মুসলিম শরিয়া আদালতেও নিষ্পত্তি করা যেত। এছাড়াও ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যকার সমস্যা নিরসনের জন্যও মুসলিম আদলতে মামলা উত্থাপন করা হতো। অটোম্যান সাম্রাজ্যে অমুসলিমদের ধর্মীয় আইনের উপর হস্তক্ষেপ করা হতো না। কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে মুসলিম আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

উসমানী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা উসমানের পুরো জীবনই ছিল আল্লাহর পথে দাওয়াত এবং জিহাদের জন্য নিবেদিত। তিনি ছিলেন ব্যক্তিত্বশালী, ন্যায়পরায়ণ, প্রজ্ঞাবান, ধৈর্যশীল, ঈমানী জজবা সম্পন্ন একজন শাসক। উসমান গাজী ৯ আগস্ট ১৩২৬ সালে ৬৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে তার ছেলে উরখানকে অসিয়ত করেছিলেন (১) প্রিয় সন্তান, আল্লাহ তোমাকে যে কাজের আদশে করেননি তা করা থেকে তুমি বিরত থাকবে। শাসনকার্যের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে উলামায়ে কেরামের পরামর্শকে আশ্রয়স্থল গ্রহণ করবে। (২) প্রিয় সন্তান, তোমার অধীনের যথাবিহীত সম্মান করবে। সৈন্যদলের প্রতি অনুগ্রহ করবে। তোমার সৈন্য ও সম্পদের মাধ্যমে যেন শয়তান তোমাকে ধোঁকা দিতে না পারে। আহলে শরিয়ত থেকে দূরে থাকা থেকে বেঁচে থাকবে। (৩) হে পুত্র, নিশ্চয় তুমি জানো, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে খুশি করা। তাই যা করবে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে বলবে। (৪) হে পুত্র, যারা শাসনের লোভে এবং একক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যুদ্ধ করে আমরা তাদের দলভুক্ত নই। আমরা ইসলামের জন্যই বাঁচব, ইসলামের জন্যই মরব। হে সন্তান এটার জন্যই তুমি যোগ্য। (৫) হে বৎস, নিশ্চয় ইসলাম প্রচার করা, তার দিকে লোকদের আহবান করা এবং মুসলিমদের সম্মান ও সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করা তোমার কাঁধে আমানত। আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তোমাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করবে। শত্রুর আক্রমণ এবং নিষ্ঠুরতা থেকে নিজের জনগণকে রক্ষা করবে। অন্যায় সহকারে কোনো মানুষের সাথে হীন আচরণ করবে না। জনগণকে সন্তুুষ্ট করবে এবং তাদের সকল উদ্দেশ্য রক্ষা করবে।

লেখক : কলামিস্ট ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের দর্পণ

আরও খবর

Sponsered content

Powered by