উপ-সম্পাদকীয়

অস্থিরতাই কামব্যাকের প্রতিবন্ধকতা

  প্রতিনিধি ৩০ জুন ২০২০ , ১০:১২:৩৬ প্রিন্ট সংস্করণ

মো. খবির উদ্দিন : এটা কোন ভূমিকম্প নয়, এটা কোন সাইক্লোন নয়, এটা কোন দাবানল নয়, এটা আকাশ ধেয়ে আসা উল্কাপিন্ডও নয়, এটা ¯স্রষ্টার দেয়া অদৃশ্য ভয়ঙ্কর মহামারি করোনা ভাইরাস। যা গোটা বিশ্বকে চোরাবালিতে আটকে দিয়েছে। হুমকিতে পড়েছে মানব জীবন। হুমকিতে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনা ভাইরাসের বিস্তর যে কৌশলে আটকানো যায় সেটা মেনে চলা উচ্চমানের ধনী দেশ ব্যতীত অনেক দেশের পক্ষেই দম নিয়ে আগানো সম্ভব হচ্ছে না। কোন দেশের জনগণই সরকার ঘোষিত বিধি নিষেধ পুরোপুরি তামিল করছে না। বিধি নিষেধ না মানাই করোনা মহামারির দীর্ঘ পথ চলাকে ত্বরান্বিত করছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ইতিমধ্যে আগাম বার্তায় জানিয়েছে কমে যাবে বিশ্ব বাণিজ্য কমপক্ষে ১৩ থেকে ৩২ শতাংশ। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বব্যাংকের বরাতে জানানো হয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দায় পড়েছে। সব অঞ্চলের মাথাপিছু আয় কমার পাশাপাশি বাড়ছে বেকারত্বের হাহাকার। চলতি ২০২০ সালে বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। তবে পরের বছরেই অর্থাৎ ২০২১ সালেই বৈশ্বিক জিডিপি ঘুরে দাঁড়াবে এবং প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

সরকার বারবার বার্তা দিচ্ছেন ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে গিয়ে নিজ পরিবারকে বিপদে ফেলবেন না। তবে এই বার্তা পালনের কঠোর ব্যবস্থা না থাকায় অতি সম্প্রতি ঈদ উৎসবে আমরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছি বাড়ি যাওয়ার সংগ্রামে। তাতে মনে হলো এ কঠিন মহামারিকে আমরা পুরোপুরি ভুলে গেছি। ঢাকার বাইরে গিয়ে ঈদের আমেজ ভোগ করতে ভালো লাগে না এমন লোকের সংখ্যা শূন্যের কোটায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিবেকের। আমরা গত তিন মাসে এই কাজগুলো একাধিকবার করে ফেলেছি।

তাই এর জন্য কড়া মাশুল আমাদের গুণতেই হবে। যে মাশুলের তেজীভাব আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করছি।
করোনা সংক্রান্ত চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাকযুদ্ধ এখনও অমীমাংসিত। কিন্তু গোটা মানব সম্প্রদায়ের অধিকাংশ এটাকে আল্লাহর দেয়া মহামারি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। করোনা প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভব হয়েছে বিষয়টি মীমাংসিত। তবে চীন ক্যারিশমেটিক কিছু অর্জন করেছে করোনা ঠেকানোর জন্য সেটা বিশ্বাবাসী মোটামুটি উপলদ্ধি করে নিয়েছে। হয়ত চীন অতি সম্প্রতি বন্ধুসুলভ অন্য দেশগুলোতেও এ বিষয়ে তালিম দিয়ে থাকবে যা আমরা আশা করছি।

আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত চীনের অর্থনীতির উপর তেমন কোন ধাক্কা লাগেনি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও চীনের বিষয় নিয়ে নেতিবাচক বিভিন্ন মন্তব্য দেখা যায়। যেমন ভবিষ্যৎ এই অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়ানোর জন্য চীন শক্ত হাতে করোনা মোকাবিলায় করছে যথারীতি নিজের চরিত্র বজায় রেখেই। সমাজকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তথ্য চেপে রেখে, সাংবাদিকদের আটক করে শক্তি ও সামর্থ্যরে প্রয়োগ ঘটিয়েছে চীন। এ কারণেই চীনে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। চীন যে মৃত্যুর হিসাব দিয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যম বলেছে এর সংখ্যা অনেক বেশি। ডেইলি মেইল এর হিসাব অনুসারে ৪২ হাজার এবং ওয়াশিংটন পোস্ট এর হিসাবে ৫০ হাজার।

ব্লুমবাগ বলেছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো এক মাসে ২ কোটি ১৪ লাখ মোবাইল গ্রাহক হারিয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি থাবায় ক্ষত-বিক্ষত। বিশ্ব বিবেক এই মহামারি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে চাচ্ছে, একই সাথে পরিবেশবাদীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন এই শতাব্দি পার না হতেই পৃথিবীর উষ্ণয়ানের কারণে আমরা কি ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হব তা নিয়ে ‘দ্য ওয়্যার’ পত্রিকায় ১৮ মে প্রকাশিত কালের উল্লেখযোগ্য একজন রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিষ্ট ও ভাষাতাত্তি¡ক নোম চমস্কির দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন “বৈশ্বিক মহামারির মূল ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদের একধাপ পেছনে গেলে ভালো হয়। ২০০৩ সালে সার্স মহামারির পর বিজ্ঞানীরা আরেকটি মহামারির পূর্বানুমান করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন সেটি হবে সার্স করোনা ভাইরাসের আরেকটি ধরন। কিন্তু জ্ঞানই যথেষ্ট নয় সে ব্যাপারে কাউকে না কাউকে কিছু করতে হতো। ওষুধ কোম্পানিগুলো আগ্রহী নয়। তারা ছোটে যেখানে মুনাফা আছে, সেখানে। তারা চেয়ে থাকে বাজারের সংকেতের দিকে। সরকার একে সামাল দিতে পারত। কিন্তু সে পথ নয়া উদারবাদী মতবাদে আটকে আছে। ট্রাম্প একে আরও বাজে অবস্থায় নিয়ে গেছেন রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (সিডিসি) অর্থায়ন বন্ধ করে। সে সব সরকারি প্রকল্প আগাম বার্তা দিতে পারত, সেগুলোও বাতিল করা হয়েছে। কাজেই আমেরিকা ছিল একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায়। চীনা বিজ্ঞানীরা এই অসুস্থতার জন্য দায়ী ভাইরাসের জিন মানচিত্র খুব দ্রুত শনাক্ত করেন। ১০ জানুয়ারির ভেতরে তারা এ সম্পর্কিত সব প্রাসঙ্গিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেন। কয়েকটি দেশ এ ব্যাপারে এক সঙ্গে সাড়া দেয় এবং বেশ ভালোভাবে এই প্রাদুর্ভাব আটকে দিতে সক্ষম হয়। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা নিয়মিত সতর্ক বার্তা দিলেও ট্রাম্প তাদের পাত্তা দেয়নি। বদলে তিনি বলে দিলেন এটি একটি সাধারণ ফ্লু যা থাকবে না। যখন মনোযোগী হলেন তখন লক্ষাধিক লোক মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মহামারি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চমস্কি ট্রাম্পের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

চমস্কি তার প্রশ্নের উত্তরে আরও বলেন আমাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে, এই সংকট যতটা মারাত্মক তার চেয়ে ভয়াবহ সংকট আসছে। বহু ক্ষতি স্বীকার করে বৈশ্বিক মহামারি থেকে সেরে ওঠা যাবে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতায়নে মেরু বরফের গলন থেকে, হিমালয়ের হিমবাহ গলন থেকে অথবা অন্যান্য ভয়ানক প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। দুনিয়া যদি তার বর্তমান চলনে অব্যাহত থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার বিরাট এলাকাই বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। অতি সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান গতিতে পৃথিবী চললে আগামী ৫০ বছরেই হয়তো সে ওই পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
চমস্কি সর্বশেষ বলেন ২০০৩ সালের সার্স মহামারির পর বিজ্ঞানীরা এই রকম আরেকটি করোনা মহামারির ব্যাপারে সতর্ক করে দিলেন। তারা বাহাস করেছিলেন, যাতে আমরা প্রস্তুতি নেই। কিন্তু কে শুনছে? বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আরেকটি বৈশ্বিকমহামারির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সেটি সম্ভবত বর্তমান সংকটের চেয়েও মারাত্মক আকার ধারণ করবে। কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে বিজ্ঞানীরা জানেন। কিন্তু কথা হচ্ছে কাউকে না কাউকে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের চোখের সামনে আছে এ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলে ফলাফল হবে ভয়াবহ।”

বিশ্বের কোন দেশই এখন পর্যন্ত এই মহামারিকে আটকানোর জন্য শতভাগ কার্যকরি কোন টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার করতে পারেনি। শুধুমাত্র একটি টিকা আবিষ্কারের জন্য উম্মুখ হয়ে আছে গোটা পৃথিবী। এ সংক্রান্তে গত ৩০.০৫.২০২০ইং এক প্রার্থনা অনুষ্ঠানের বক্তব্যে অস্ত্রের তহবিল মহামারি ঠেকানোর বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার ওপর ব্যবহারের জোর দিয়েছেন ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস। কেউ টিকা আবিষ্কারে সফল হলে তা বিশে^র সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়ারও আহবান জানান তিনি।

গোটা বিশ্ব অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। পুরোপুরি কামব্যাক করার পূর্বেই বিভিন্ন দেশ তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য লকডাউন তুলে দিচ্ছে। আক্রান্তের দিক থেকে প্রথম অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে গেছে। কারফিউ উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ। পুলিশ হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হওয়ার ঘটনায় শুরু হওয়া বর্ণবাদের বিরুদ্ধে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র। কারফিউ উপেক্ষা করে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের শহরে শহরে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে গন্ডি পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, ফ্রান্সের প্যারিস, জার্মানির বার্লিন, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, নেদারল্যান্ডস থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের শহরগুলোতেও। এ বিক্ষোভের জায়গাগুলো করোনা বিস্তারের কেন্দ্রতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাকে কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আপাদমস্তক অরাজনৈতিক ব্যক্তি। তিনি এই সংঘাতের সময় উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সংঘাতকে উস্কে দিয়েছেন। তিনি তার পক্ষে জনমত টানতে চাইছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে নিজের জন্য ইতিবাচক ফলাফলের।

বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তনের কারণ হতে পারে করোনা ভাইরাস। ভবিষ্যতে চীন য্ক্তুরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটবে। করোনা পরবর্তী বিশে^ চীন অর্থনৈতিকভাবে আরও শাক্তিশালী হবে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। বিশ্লেষকগণ আরও মনে করেন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র নিকট ভবিষ্যতে আস্তে আস্তে তামাম দুনিয়া থেকে তাদের দাদাগিরি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে এবং এর জন্য পুরোপুরিভাবে দায়ী হবেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের অস্তিরতা, অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতাই হবে মূল কারণ।

আমাদের দেশে এ মহামারিকালীন সময়ে নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৭ হাজারের উর্ধে¦ পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে আরও ৮ হাজারের উর্ধে¦। এ পর্যন্ত মারা গিয়েছে ২০ জন। এই করোনাকালীন মুহূর্তে পুলিশ বাহিনী তাদের কর্মদক্ষতার জন্য অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তারপরেও তারা তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করে যাচ্ছেন। স্যালুট তাদের দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসার জন্য। এত ঝুঁকি থাকার পরেও তারা দক্ষতার সাথে সম্মুখ যোদ্ধার মত কাজ করে যাচ্ছেন। এই ক্রান্তিকালে এটাই জাতি আশা করছে।

আমরা খুবই অস্থির হয়ে পড়েছি। কেউ এখন বাসায় থাকতে চাচ্ছে না। যাদের কাজ আছে তাদের বিষয়টি ভিন্ন। কিন্তু যাদের গালগল্প আছে তাদের কি হবে। এটা অস্থিরতা বা গল্পের সময় নয়। এটা ভয়ঙ্কর বিপদের সময়। এই বিপদকে অবহেলা করলে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। সর্বস্তরের জনগণ সচেতন না হলে শুধু সরকারের পক্ষে এ মহামারি ঠেকানো আদৌ সম্ভব নয়। এখনও এদেশে কমপক্ষে পঁচিশ শতাংশ লোক মাস্ক ব্যবহার করছে না, তা ঢাকার ভিতরে একটু অনুন্নত এলাকা ঘুরলেই গোটা দেশের চিত্র ফুটে উঠবে। কে শুনে কার বয়ান। তবে এর জন্য সবশেষে হয়ত বেধড়ক লাঠিচার্জের প্রয়োজনও হতে পারে। এই লাঠিচার্জ হবে আমাদের বোধশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। হয়ত এই লাঠিচার্জই একদিন করোনাকে শূন্যের কোটায় আনতে পারবে। বাঁচাতে হবে সর্বস্তরের জনগণকে। বাঁচাতে হবে দেশ। বাঁচাতে হবে অর্থনীতি। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশও করোনা থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্ত হয়ে যাবে ইন্শাআল্লাহ্।

লেখক : কলামিস্ট
E-mail: [email protected]
মোবাইল: ০১৭১১-২৭৩২৮০

আরও খবর

Sponsered content

Powered by